ট্রেড লাইসেন্স কি এবং কেন প্রয়োজন?
বাংলাদেশে যেকোনো ব্যবসা আইনগতভাবে পরিচালনা করার জন্য ট্রেড লাইসেন্স একটি অপরিহার্য দলিল। সহজ কথায়, এটি আপনার ব্যবসার অনুমতিপত্র। আপনি ছোট দোকান চালান বা বড় কোম্পানি খোলেন, আপনার ব্যবসার ধরন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ (যেমন: সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ) থেকে এই লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়।
কেন ট্রেড লাইসেন্স এত গুরুত্বপূর্ণ?
- আইনি বৈধতা: এটি আপনার ব্যবসাকে সরকারি স্বীকৃতি দেয় এবং আইনি জটিলতা এড়াতে সাহায্য করে।
- ব্যাংকিং সুবিধা: ব্যবসার নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে বা ঋণ নিতে ট্রেড লাইসেন্স প্রায়শই বাধ্যতামূলক।
- বিশ্বাসযোগ্যতা: গ্রাহক এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক পার্টনারদের কাছে আপনার ব্যবসার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে।
- অন্যান্য লাইসেন্স প্রাপ্তি: অনেক ক্ষেত্রে, অন্যান্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স (যেমন: ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র) পেতে ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন হয়।
কারা ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করে?
আপনার ব্যবসার অবস্থান অনুযায়ী ট্রেড লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ ভিন্ন হয়:
- সিটি কর্পোরেশন এলাকা: ঢাকা উত্তর/দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন তাদের নিজ নিজ এলাকার ব্যবসার জন্য লাইসেন্স প্রদান করে।
- পৌরসভা এলাকা: পৌরসভা এলাকার ব্যবসার জন্য সংশ্লিষ্ট পৌরসভা অফিস থেকে লাইসেন্স নিতে হয়।
- ইউনিয়ন পরিষদ এলাকা: ইউনিয়ন পরিষদভুক্ত এলাকার ব্যবসার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়।
ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার ধাপসমূহ
ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়া কিছুটা সময়সাপেক্ষ মনে হলেও ধাপগুলো অনুসরণ করলে কাজটি সহজ হয়ে যায়।
১. সঠিক কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ:
আপনার ব্যবসার ঠিকানা কোন এলাকার অধীনে পড়েছে (সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা নাকি ইউনিয়ন পরিষদ) তা নিশ্চিত হোন এবং সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট অফিসে যোগাযোগ করুন।
২. আবেদন ফরম সংগ্রহ:
সংশ্লিষ্ট অফিস (সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভা/ইউনিয়ন পরিষদের রাজস্ব বিভাগ বা লাইসেন্সিং শাখা) থেকে ট্রেড লাইসেন্সের আবেদন ফরম সংগ্রহ করুন। কিছু কিছু সিটি কর্পোরেশন অনলাইনে আবেদন ফরম পূরণের সুযোগ দিয়ে থাকে, তাদের ওয়েবসাইটে খোঁজ নিতে পারেন।
৩. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ:
আবেদন ফরমের সাথে কিছু জরুরি কাগজপত্র জমা দিতে হয়। ব্যবসার ধরন অনুযায়ী এগুলোর কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে, তবে সাধারণত যা যা লাগে:
- জাতীয় পরিচয়পত্রের (NID) ফটোকপি।
- ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্থান নিজের হলে হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের রশিদ, ভাড়া হলে ভাড়ার চুক্তিপত্রের ফটোকপি।
- পাসপোর্ট সাইজের ছবি (সাধারণত ৩ কপি)।
- লিমিটেড কোম্পানি হলে Certificate of Incorporation, Memorandum of Association (MoA), Articles of Association (AoA)।
- অংশীদারি ব্যবসা হলে অংশীদারি চুক্তিপত্রের ফটোকপি।
- ফ্যাক্টরি বা কারখানার ক্ষেত্রে পরিবেশ ছাড়পত্র, ফায়ার লাইসেন্স ইত্যাদি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।
(গুরুত্বপূর্ণ: আবেদন করার আগে সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে প্রয়োজনীয় কাগজের সঠিক তালিকা জেনে নিন।)
৪. আবেদন ফরম পূরণ:
নির্ভুল তথ্যে আবেদন ফরমটি পূরণ করুন। ব্যবসার নাম, ঠিকানা, ধরণ, মালিকের তথ্য ইত্যাদি সঠিকভাবে লিখুন।
৫. আবেদন জমা ও ফি প্রদান:
পূরণকৃত ফরম এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নির্ধারিত ডেস্কে জমা দিন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাগজপত্র যাচাই করে দেখবেন। সব ঠিক থাকলে আপনাকে নির্ধারিত ফি জমা দেওয়ার জন্য ব্যাংক স্লিপ বা রসিদ দেওয়া হবে।
ট্রেড লাইসেন্সের ফি ব্যবসার ধরন ও মূলধনের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। এর সাথে সাইনবোর্ড ফি (যদি থাকে) এবং ভ্যাট যুক্ত হতে পারে। নির্দিষ্ট ব্যাংকে বা অফিসের ক্যাশ কাউন্টারে ফি জমা দিন।
৬. লাইসেন্স সংগ্রহ:
ফি জমা দেওয়ার রসিদ সংশ্লিষ্ট ডেস্কে জমা দেওয়ার পর আপনার আবেদন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে। কিছু ক্ষেত্রে পরিদর্শনের প্রয়োজন হতে পারে। সব প্রক্রিয়া শেষে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে আপনার নামে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হবে এবং আপনি তা অফিস থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।
কিছু জরুরি বিষয় মনে রাখুন:
- নবায়ন: ট্রেড লাইসেন্স সাধারণত এক অর্থ বছরের জন্য ইস্যু করা হয় এবং প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নবায়ন করতে হয়। নবায়ন না করলে জরিমানা হতে পারে।
- সঠিক তথ্য প্রদান: আবেদনে কোনো ভুল বা মিথ্যা তথ্য দিলে লাইসেন্স বাতিল হতে পারে।
- একাধিক ব্যবসা: একই ঠিকানায় একাধিক ব্যবসা পরিচালনা করলে প্রতিটি ব্যবসার জন্য আলাদা ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন হতে পারে (নিয়ম অনুযায়ী)।
ট্রেড লাইসেন্স করা হয়তো কিছুটা ঝামেলার মনে হতে পারে, কিন্তু এটি আপনার ব্যবসার আইনি ভিত্তি এবং ভবিষ্যতের সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। তাই দেরি না করে আপনার ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া শুরু করুন!